ইতোমধ্যে বহুল আলোচিত দুই ভাই সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ইমতিয়াজ হাসান রুবেলসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের আরও ১৬ জন নেতা। আরও অনেকেই গ্রেপ্তাররে প্রক্রিয়ায় রয়েছেন।
তবে সবকিছুর ওপরে জেলার সর্বত্র এবার তুমুল আলোচনা হচ্ছে বরকত-রুবেল গংদের পৃষ্ঠপোষকদের নিয়ে।
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘ফরিদপুরে আর কাউকে সন্ত্রাসী ও অপরাধমুলক কর্মকাণ্ড করতে দেয়া হবে না। কারও বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
জানা গেছে, সম্প্রতি পুলিশের চলমান অভিযানের শুরুতেই গত ৭ জুন রাতে ৭ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হন সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেল। বরকত ছিলেন ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েই তিনি শহর যুবলীগের সভাপতি হন। এছাড়া জেলা বাস মালিক গ্রুপের সভাপতিও হন। তারপরই শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ পান।
বরকতের ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেলের সাংবাদিকতার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি হন এবং একটি পত্রিকার ডিক্লারেশনও নেন। ওই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন রুবেল আর প্রকাশক হন বরকত। এছাড়া ফরিদপুরের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনও তারা কব্জায় নেন। বিরুধীমতকে দমন করতে তারা স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে চরমপন্থার একের পর এক জঘন্য নজির সৃষ্টি করেন তারা। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় সন্ত্রাস, জমি দখল, টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্ম করে বেড়াতেন তারা। এরপর একের পর এক বিভিন্ন সরকারি সংস্থা দখল করে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও জমি দখল করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। যাকে খুশি তাকে মারধর ও লাঞ্ছিত করতেন। তাদের আক্রমণের শিকার হয়ে অনেকে শহর থেকে পালিয়ে অন্যত্র চলে যান।
ফরিদপুরের বাইরেও খুলনা, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মাগুরা, পটুয়াখালী, শেরপুর, সিলেট, গাজীপুর ও দিনাজপুরেও ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণ ছিলো তাদের। গ্রেপ্তারের পর ঢাকায় সিআইডি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তারা এসব জানিয়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, জবানবন্দিতে তারা তাদের অন্যান্য আরও অনেক সহযোগীর নামও বলেছেন। তাদের গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া চলছে।
ফরিদপুর জেলা পুলিশের সূত্র জানায়, এ প্রক্রিয়ায় মানি লন্ডারিং মামলায় সর্বশেষ ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম খন্দকার ওরফে লেভি, শহর যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসিবুর রহমান ফারহান এবং জেলা শ্রমিক লীগের কোষাধ্যক্ষ বিল্লাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের ঢাকায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
আওয়ামী লীগের দ্বায়িত্বশীল নেতাদের অভিযোগ, সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও তার ভাই মোহতেসাম হোসেন বাবরের হাত ধরে রাজনীতিতে আসা রুবেল ও বরকত রাতারাতি ফরিদপুরের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন।
ফরিদপুরের জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি শামসুল হক ভোলা মাষ্টার বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফরিদপুরের বিভিন্ন উন্নয়নে যেসকল কর্মকাণ্ড অনুমোদন করেছেন তার সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি হয়েছে।’
তার অভিযোগ, ‘এই লুটপাটে বরকত-রুবেলকে ব্যবহার করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং তার ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর। এখন সবার সম্পদের হিসাব নিলেই মূল খবর বেরিয়ে আসবে।’
ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন বলেন, ‘রুবেল-বরকতের জন্ম হঠাৎ করে হয়নি। আশ্রয়-মদদদাতাদের কারণে তাদের উত্থান হয়েছে। তাদের দাপটে আওয়ামী লীগের নিবেদিত কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে ছিলো। সকলকেই আইনের আওতায় আনতে হবে, যাতে ক্ষমতা পেলেই কেউ যা খুশি তা-ই করতে না পারে।’
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিপুল ঘোষ বলেন, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের দুর্নীতির সঙ্গে সরকারি একটি গণমাধ্যমে কাজ করে এক সাংবাদিকের সম্পৃক্ততার কথা ওঠে এসেছে। পাশাপাশি বরকতের শ্বশুর ও তার শ্যালকদের চাঁদাবাজি ও জমি দখলের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার।
ফরিদপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ বোস বলেন, দলের সুবিধাভোগীরাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি নূর মোহাম্মদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা শওকত আলী, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মনির হোসেনকে কুপিয়ে আহত করেছিলেন। তারা ফরিদপুর প্রেসক্লাবে একাধিকবারের সভাপতি ও ‘নাগরিক বার্তা’ পত্রিকার সম্পাদক কবিরুল ইসলাম সিদ্দিকী, প্রথম আলোর সাংবাদিক পান্না বালা এবং ফরিদপুর মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. হালিমকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে।
সব সন্ত্রাসীকে আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানান জেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভী মাসুদ।
ফরিদপুর সচেতন নাগরিক কমিটির সাবেক সভাপতি মজিবর রহমান বলেন, দখলদারদের অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে যার যার সম্পত্তি, তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হোক। এছাড়াও যে সকল সম্পদ অবৈধ ভাবে উপার্জন করেছে সেগুলো বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জমা দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।